বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা জমিদারবাড়িগুলোর অন্যতম রাজশাহী জেলার দৃষ্টিনন্দন পুঠিয়া রাজবাড়ি। রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলায় এর অবস্থান। বাঘার আম বাগান ঘুরে ঠিক গোধূলি বেলায় ইতিহাস-ঐতিহ্য আর ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে এখনো টিকে থাকা কালের সাক্ষী জমিদারবাড়িটিতে হাজির হলাম। গাড়ি থেকে নেমেই ছোখ ছানাবড়া। বাড়ির সামনে বিশাল মাঠ। মাঠ পেরুলেই মঠ। মন ভুলানো ঝুল বারান্দা। টেরা কোটার মিশেলে দুইতলা বাড়ি। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপর তলায় ওঠার পর মনের মাঝে অন্যরকম ভালোলাগা ভর করে। বাড়ির বাম পাশে পুকুর, আর ডান পাশে উপাসনালয়। তবে সড়ক বিভাজনে এখন পুকুরটি আলাদা হয়েছে। বর্তমানে পুরো বাড়িটির চুনকাম করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই জমিদারি আমলের তৈজসপত্র দিয়ে পর্যটক আকর্ষণের জন্য মিউজিয়াম খোলা হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কেয়ারটেকার ঘরের দরজাগুলো খুলে আমাদেরকে ভিতরে প্রবেশের সুযোগ করে দিলেন। তখন দেখলাম থরে থরে কাচের শোকেস রাখা আছে, বাড়ির ব্যবহূত তৈজসপত্র সাজানোর জন্য। পুঠিয়া জমিদারি সতেরো শতকের প্রথম দিকে মোগলদের সৃষ্ট বাংলার প্রাচীনতম জমিদারিগুলোর অন্যতম। বাড়িটি মহারানি হেমন্তকুমারী দেবীর বাসভবন ছিল। বাংলার বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনের মধ্যে এই বাড়িটি অন্যতম অকর্ষণীয় ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা।
এর নির্মাণকাল ১৮৯৫ সাল। রানি হেমন্তকুমারী দেবী তার শাশুড়ি মহারানি শরত্ সুন্দরী দেবীর সম্মানে বাড়িটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। লোকমুখে প্রচলিত আছে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে নীলাম্বর রাজা উপাধি লাভ করেছিলেন। সেই থেকে পুঠিয়া জমিদার বাড়িটি রাজবাড়ি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৭৪৪ সালে জমিদারি স্বত্ব ভাগাভাগি হলে জ্যেষ্ঠ শরিক সাড়ে পাঁচ আনা ও অন্যান্য তিন শরিক প্রত্যেকে তিন আনা অংশের মালিক হন। পুঠিয়ার জমিদারিত্ব ১৯৫০ সালের পূর্ব পাকিস্তান এস্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যাক্টের অধীনে বিলুপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ছিল। বাড়িটির দেয়ালে এখনো দৃষ্টিনন্দন ফুল ও লতাপাতার চিত্রকর্ম বিদ্যমান। এ থেকেই অনুমান করা যায় মহারানি হেমন্তকুমারী দেবী শৌখিনও ছিলেন বেশ। বাড়িটির আশপাশে বেশ কিছু দিঘি ও মন্দির রয়েছে। ওগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় মন্দির হচ্ছে শিব মন্দির। প্রতিটি মন্দিরের দেয়ালেই চেখে পড়ার মতো পোড়ামাটির কারুকাজ। বাংলাদেশের সবচেয়ে অধিক সংখ্যক ঐতিহাসিক মন্দির রয়েছে এই পুঠিয়ায়।
বিভিন্ন সময়কালে রাজবাড়ির জনহিতৈষী জমিদাররা এসব মন্দিরগুলোর প্রতিষ্ঠাতা। পুঠিয়া রাজবাড়িটির নকশা ইন্দো-সারাসেনিক স্থাপত্য রীতি অনুসারে নির্মিত। রাজা পিতাম্বর ছিলেন পুঠিয়া জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা। আর এসব ভাবতে ভাবতে রাজবাড়ির আঙ্গিনায় ঘুরতে গিয়ে ক্ষণিকের জন্য নিজেকে রাজা রাজা মনে হলো। পুঠিয়া সম্পর্কে আরেকটু না লিখলেই নয়। এই প্রাচীন জনপদের অধিপতি ছিলেন লস্করি খান। সম্রাট আকবরের শাসনামলে লস্করি খান বিদ্রোহী হয়ে উঠলে সেনাপতি মানসিংহ শাসনভার পিতাম্বরের হাতে তুলে দেন। সেই থেকেই পুঠিয়া জমিদারির গোড়াপত্তন। ব্রিটিশ-বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদারি ছিল এই পুঠিয়া রাজবংশের। সম্পদের দিক থেকেও তারা ছিল ব্রিটিশ-বাংলার সবচেয়ে ধনী। সেসব আজ ইতিহাস। ভারত স্বাধীন হলে তত্কালীন পাকিস্তান সরকার জমিদারি প্রথা বাতিল করার পাশাপাশি জমিদারের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। অতঃপর পুঠিয়া রাজবংশ ভারতে চলে যায়। ঘুরে ঘুরে দেখার পর আমরাও বনলতা সেনের নাটোর জেলার মহাসড়ক হয়ে ঢাকায় ফেরার পথ ধরি।
যাবেন যেভাবে
ঢাকার গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে দিনে রাতে রাজশাহীর পুঠিয়া যাওয়ার জন্য বিভিন্ন কোম্পানির পরিবহন রয়েছে। সার্ভিস ভেদে ভাড়া ৬০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনসহ দেশের বিভিন্ন রেল জংশন থেকেও রাজশাহী যাওয়া যাবে। শহর থেকে পুঠিয়ার দূরত্ব মাত্র ৩২ কিলোমিটার। পুঠিয়া রাজবাড়িটিকে স্থানীয় অনেকে পাঁচআনি জমিদারবাড়ি নামেও ডাকে।
থাকা-খাওয়া
পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার জন্য রাজশাহী শহরের সাহেব বাজার, মিরেরটেক, টিক্কাপাড়া, সাধুর মোড়ে বিভিন্ন মান ভেদে আবাসিক ও খাবার হোটেল রয়েছে।
ভ্রমণ তথ্য
যারা সরাসরি রাজশাহী যাবেন তাদের জন্য বাড়তি পাওনা হবে পদ্মা নদীর তীর, সেন্ট্রাল পার্ক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।